বিলুপ্তির পথে টাঙ্গাইলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষা!

মাতৃভাষার বই ছাপানো হলেও অস্তিত্ব সংকটে পড়ে বিলুপ্তির পথে টাঙ্গাইলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। নিজস্ব ভাষা বিষয়ক শিক্ষকের অভাব যেমন রয়েছে তেমনি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিয়মিত চর্চা না থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেতাদের। মাতৃভাষার অপমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের কার্যকর ভূমিকার আহবান স্থানীয়দের।

বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মতো ভাষা প্রচলিত আছে। মধুপুর গড় এলাকায় ৩৫ শতাংশ গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের আর বাকি ৬৫ শতাংশই বাঙালি জনগোষ্ঠী মানুষের বসবাস। তার মধ্যে মধুপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মান্দি ভাষা বা আচিক ও কোচ ভাষা প্রচলিত আছে।২০১৭ সালে সরকারি উদ্যোগে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের কিছু ক্লাসে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয় মাতৃভাষায় ছাপানো বই। কিন্তু বাংলা ভাষার সঙ্গে তাল মেলানোসহ নানা কারণে জেলার মধুপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না মাতৃভাষা।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষায় কথা বলা ও জানা মানুষের কাছে এই ভাষার অর্থ অপরিচিত। নিজস্ব ভাষা বিষয়ক শিক্ষকের অভাবে নিজ গোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের কাছেও মায়ের ভাষার এই মানে ক্রমেই হয়ে উঠছে অপরিচিত।

মধুপুর গড়ের স্থানীয় বাসিন্দা মনিকা ম্রং আমার টাঙ্গাইলকে বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম বাঙালিরা মধুপুর বনে আমাদের আশপাশে ছিল না। এখন কিন্তু অনেক বাঙালি চলে এসেছে। বাঙালি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের সন্তানরা স্কুলে যায় বা বিভিন্ন কারণে তাদের সঙ্গে মিশতে হয়। এসব কারণে আমাদের ভাষা বিলুপ্তির পথে। অঞ্চল ভিত্তিক কালচারাল বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের একাডেমি খোলার দাবি জানাচ্ছি। তাহলে সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি আমাদের মান্দি ভাষার চর্চা থাকবে।

অপর বাসিন্দা জেমস ম্রং আমার টাঙ্গাইলকে বলেন, আমি ছেলে মেয়েকে মান্দি ভাষায় কথা বললেও তারা আমাকে বাংলা ভাষায় উত্তর দেয়। এলাকায় বা স্কুলে বাঙালিদের সঙ্গে চলাচলের কারণে এমন হয়েছে। বাংলা ভাষা বেশি ব্যবহার হচ্ছে।

স্কুলছাত্রী সেংবিয়া রিছিল বলেন, স্কুলে আমার ফ্রেন্ডস সার্কেল সব বাঙালি। সেখানের তেমন আমাদের ভাষার চর্চা হয় না। তবে বাড়িতে আমাদের ভাষার চর্চা হয়। পরিবার ও স্কুলে যদি আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারতাম তাহলে মান্দি ভাষার চর্চা থাকতো। অপর দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক বা কলেজে মান্দি ভাষার প্রচলন থাকলে আমাদের ভাষার অনেক উন্নতি হতো।অপর স্কুলছাত্রী লামিসা রিছিল বলেন, বড়দের কাছ থেকে শুনে শুনে একটু একটু বলার চেষ্টা করি। কিন্তু বড়রা না বললে আমরা আর বলতে পারি না। আমাদের আশপাশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, কেউ আর মান্দিতে কথা বলে না। বই থাকলেও শিক্ষক না থাকার কারণে আমরা শিখতে পারছি না।

স্কুলশিক্ষিকা মার্জিনা চিসিম বলেন, মান্দি ভাষায় কথা বললেও বাজারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হয়। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাংলা ভাষা জানতাম না। স্কুলে যাওয়ার পর বাংলা ভাষা শিখেছি। স্কুলেও আমাদের ভাষা প্রয়োগ হয় না। এতে আমাদের ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। আমাদের ভাষা ধরে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।

গাছাবাড়ি মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা বলেন, আমাদের ভাষা বাড়িতে একটু হলেও ব্যবহার করছি। এ ছাড়াও আমাদের সন্তানরা গান নাচসহ অনেক কিছুই মান্দি ভাষায় পারে না। অনেকেই শিখে না বা জানতে চায় না। আমি তেমন পারি না। আমার কাছ থেকে সন্তানরা আর কি শিখবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভাষা শিখতে পারলে আমাদের ভাষা বিলুপ্তির কোনো অবকাশ নেই। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মতো সব জায়গায় সমানতালে মান্দি ভাষা ব্যবহার করতে পারি না। মান্দি ভাষার বই তৈরি করা হলেও শিক্ষকের অভাবে পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজেন নকরেক আমার টাঙ্গাইল কে বলেন, ঘর থেকে বের হলেই বাজার ঘাট অফিস আদালতে আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হয়। যে কারণে আমাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা বা চর্চার প্রয়োজন আছে। আমাদের অভিভাবকরা অসচেতন। পরিবারে যদি তারা ভাষা ব্যবহার করতো তাহলে একটু হলেও চর্চা থাকতো। প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের ভাষার বই ছাপানো হলেও এগুলো আর ব্যবহার হচ্ছে না। শিক্ষক না থাকার কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে না। চর্চার মাধ্যমে সংরক্ষণ করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০০৮ সালে গড় এলাকায় ১২টি স্কুল চালু করা হয়েছিল। যেখানে গারো শিশুদের আচিক ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হতো। কিন্তু তিন বছর চলার পর দাতা সংস্থার অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় শিশুদের তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে আগামী প্রজন্ম আচিক ভাষা নিয়ে শঙ্কায়।

Share this post

PinIt
submit to reddit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top