প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইলো আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহাযার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট ২ হাজার টাকার চেক প্রেরিত হলো। আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন। – শেখ মুজিব তারিখ ২০.১২.১৯৭২’
সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই চিঠি ৫০ বছর ধরে বুক আগলে রেখেছেন শহিদ রমযান আলীর স্ত্রী ভিখারি ইফাতন বেওয়া। তার নিকট এটি শুধু কাগুজে চিঠিই নয়, বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নিহত স্বামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অনটনের সংসারে অনেক কিছু হারালেও মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর অবদানের স্বীকৃতির সেই চিঠি নিয়ে তিনি আজও গর্ব অনুভব করেন। ইফাতন বেওয়ার বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতায়। একাত্তরে পানকাতা গ্রাম প্রশাসনিকভাবে গোপালপুর উপজেলাধীন ছিল। এখন সেটি ধনবাড়ী উপজেলার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধে পানকাতা হাই স্কুল ছিল কাদেরীয়া বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। একাত্তরের ৩০ সেপ্টেম্বর গোপালপুর থেকে পাকিস্তানি হানাদাররা পানকাতা ক্যাম্প দখলে এগিয়ে আসে। মাহমুদপুর বটতলায় মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল বাধা দেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বর্বররা শুরু করে গণহত্যা।বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার খসরু জানান, সেদিন গোপালপুর উপজেলার মাহমুদ-পুর গ্রামে ১৪ জন এবং পানকটা গ্রামে তিন জন শহিদ হন। শহিদদের মধ্যে পানকটা গ্রামের রমযান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছাসেবক। সেসময় ইফাতনের মেয়ে রমিছা ছিলেন পেটে। ছেলে তারেকের বয়স ছিল তিন বছর। দিনমজুর রমযান রেখে যান শুধু বসতভিটা। স্বামী হারানোর পর দুই অবুঝ সন্তান নিয়ে ইফাতনের কঠিন সংগ্রাম শুরু হয়। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ শুরু করেন। মেয়ে রমিছাকে বিয়ে দেন এক দিনমজুরের সঙ্গে। সে মেয়েও পাঁচ বছরের মাথায় দুই সন্তান নিয়ে বিধবা হন। পুত্র তারেক গাজীপুরে লেবারি করেন। মায়ের খোঁজখবর রাখেন না। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ইফাতন এক পর্যায়ে পাড়ায় ‘মাগন’ করে পেট চালাতে থাকেন। অপুষ্টি ও অসুখ-বিসুখে শরীর ভেঙে পড়ায় এখন হাঁটাচলা করতে পারেন না। বাড়ির উঠানে চেয়ারেই কাটে সারা দিন। পাড়াপড়শিরা এক বেলা খাবার দিয়ে যান। তা দিয়েই পেট চলে।
বলিভদ্র ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আমিনুল ইসলাম জানান, খাবার কষ্ট দেখে গত বছর তাকে বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়া হয়। মাসে ৫০০ টাকার ভাতায় দুই বেলা খাবারই জোটে না। ডাক্তার, ওষুধ ও কাপড়চোপড় তো দুরস্ত। তিনি বলেন, গ্রামের স্কুলমাঠে জনসভা হয়। সেখানে নেতারা ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার কথা বলেন। কিন্তু শহিদ রমযান আলীর নিরন্ন পরিবারের খোঁজ নিতে কেউ আসেন না। এক জন শহিদের স্ত্রী ভিক্ষা করে খায়, এক বেলা খেয়ে তিন বেলা উপোস করে এমন লজ্জা ও দায় সবার। পড়শি কল্পনা বেগম জানান, বঙ্গবন্ধু ৫০ বছর আগে চিঠি ও ২ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে শহিদের স্ত্রী হিসেবে ইফাতনকে সম্মানিত করেছিলেন। কিন্তু তারপর কোনো সরকারই অকাল বিধবা ইফাতনের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসেননি। পড়শি মিনারা বেগম জানান, দিনমজুর ছেলে ইফাতনের খোঁজখবর রাখেন না। রোগে-শোকে, অপুষ্টিতে তিনি এখন চলত্শক্তিরহিত। থাকার ঘরটি ভাঙাচোরা। চাল চুয়ে পানি পড়ে। একাত্তরে কপাল ভাঙা ইফাতনের নিয়তি সারা জীবনই উপহাস করেছে।
ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম জানান, ইফাতন বেওয়ার দুঃসহ জীবনের কথা শুনে তিনি ব্যথিত। ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসলাম হোসাইন জানান, তিনি নতুন এসেছেন। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক জানান, এক জন শহিদের স্ত্রী ভিক্ষা করেন বা অনাহারে থাকেন, এমন খবর বেদনাদায়ক। মাহমুদপুর গণহত্যা স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ফলকে যে সতের শহিদের নাম উত্কীর্ণ করা হয়েছে রমযান তাদের একজন। ইফাতনের এমন দুরবস্থার কথা জানা ছিল না। পানকাতা গ্রাম এখন ধনবাড়ী উপজেলাধীন হলেও গোপালপুর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা দেওয়া হবে।