টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার চাষিরা আনারস আকারে বড় ও এর রং আকর্ষণীয় করতে রাসায়নিক ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় চাষিরা বলছেন, এলাকার বাইরে থেকে বিনিয়োগকারীরা এসে জমি বর্গা নিয়ে আনারস চাষ করছেন। তাঁদের মধ্যে রাসায়নিক প্রয়োগের প্রবণতা বেশি। আনারসে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করায় মানুষের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এ মৌসুমে মধুপুরে ৫ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। গত বছর উপজেলার ৫ হাজার ৮৫০ হেক্টরে আনারস চাষ করা হয়েছিল।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মধুপুর বনাঞ্চলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের লোকজন আনারস চাষ শুরু করেন। গারো সম্প্রদায়ের অজয় এ মৃ বলেন, পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে এ অঞ্চলে তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকজন আনারস চাষ শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যে এ আনারসের সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।গত দুই দশকে এ এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। ফলে আনারস বাজারজাতকরণ অনেক সহজ হয়েছে। এখন বাইরে থেকেও বিনিয়োগকারীরা এসে জমি বর্গা নিয়ে আনারস চাষ করছেন। এসব বিনিয়োগকারীর মধ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। ফলে যাঁরা রাসায়নিক ছাড়া চাষ করছেন, তাঁরা লোকসান গুনছেন।
কৃষক, কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মী এবং আনারস চাষে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বাইরের বিনিয়োগকারীরা জমি বর্গা নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের দিয়ে জমি চাষ করান। তাঁরা কৃষকদের দ্রুত পাকাতে ও রং সুন্দর করতে আনারসে রাসায়নিক ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
সূত্রগুলো আরও জানায়, আনারসের চারা রোপণের পর থেকে দ্রুত ফল আসা, ফল বড় করা, দ্রুত পাকানো ও রং আকর্ষণীয় করতে কয়েক ধাপে রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত গাছে ৬০টি পাতা হওয়ার পর আনারস ধরে। কিন্তু ২৮টি পাতা হওয়ার পরেই ফল ধরার জন্য আনারসে রাইপেন, ইথিপ্লাসসহ ইথোফেন গ্রুপের রাসায়নিক দেওয়া হয়। এতে ফল আসার পর তা বড় করার জন্য প্লানোফিক্স, সুপারফিক্সসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনারস পাকানোর জন্য এবং রং আকর্ষণীয় করতে আবার রাইপেন, ইথিপ্লাসসহ ইথোফেন গ্রুপের নানা রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়।মধুপুর উপজেলা সদরের অধিবাসী হীরা তালুকদার গড় এলাকায় জমি বর্গা নিয়ে আনারস চাষ করেন। তিনি জানান, ক্রেতারা বড় এবং ভালো রঙের আনারস বেশি কেনেন। তাই বাধ্য হয়ে রাসায়নিক ব্যবহার করেন। এতে মুনাফা বেশি হয়। বিভিন্ন সার ও কীটনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসব রাসায়নিক সরবরাহ করছে। এসব রাসায়নিকের বোতলের গায়ে পাকানোর জন্য ব্যবহারের নিয়ম লেখা থাকে না। কিন্তু কৃষকেরা পাকানোর জন্য সব সময় এগুলো ব্যবহার করেন। একাধিক কৃষক জানান, দ্রুত ফল ধরা এবং ফল বড় হওয়ার জন্য ১০ লিটার পানিতে ২ থেকে ৩ মিলিলিটার রাসায়নিক ব্যবহারের কথা বলা হয়। তবে কোনো কোনো কৃষক ১০ লিটার পানিতে ২ থেকে ৩ মিলিলিটারের স্থলে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিলিটার পর্যন্ত রাসায়নিক মিশিয়ে আনারসে ছিটান। এতে আনারস দ্রুত পেকে যায় ও রং সুন্দর হয় এবং একসঙ্গে পুরো জমির আনারস বাজারজাত করা যায়।টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য সংরক্ষণ) আরিফুর রহমান জানান, ব্যবহারবিধি অনুযায়ী রাসায়নিক প্রয়োগ করলে কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহার করলে ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়।
গত শুক্রবার বেরিবাইদ, গাছাবাড়ি, জয়নশাহী, পীরগাছা, মহিষমারা এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, আনারসের বাগানে অনেকে রাসায়নিক ছিটাচ্ছেন। তাঁরা বলেন, রাসায়নিক ছাড়া চাষ করা আনারস আকারে ছোট হয়। সম্পূর্ণ হলুদ হয়ে পাকে না। অপরদিকে রাসায়নিক ব্যবহার করলে রং আকর্ষণীয় হয় ও ফলও বড় হয়। ক্রেতারা এসব বড় ফল ও হলুদ রং দেখে আকৃষ্ট হন।
এসব রাসায়নিক কোথা থেকে কেনেন? জানতে চাইলে চাষিরা বলেন, মধুপুর অঞ্চলে শতাধিক দোকানে এসব রাসায়নিক বিক্রি হচ্ছে। এগুলো সব সময় কিনতে পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএম) শফিকুল ইসলাম বলেন, আনারস বড় করা ও পাকানোর জন্য যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার করলে নানা জটিল রোগ হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে এসব রাসায়নিক ব্যবহার করলে ওজন কমে যেতে পারে এবং কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।