মাতৃত্বকালীন ৬ মাসের ছুটি একজন কর্মজীবি নারীর অধিকার। কিন্তু সেই মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে চরম হয়রানি হচ্ছেন টাঙ্গাইল গোপালপুর উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত নারী শিক্ষকরা। এখানে হাসপাতালে সিজার করার পর প্রসূতি ও নবজাতককে সরাসরি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে গিয়ে ছুটি মঞ্জুর করার অলিখিত বিধান চালু করা হয়েছে। এমন অমানবিক রেওয়াজে ক্ষোভ বিরাজ করছে শিক্ষকদের মধ্যে। সাজনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মাকসুদা বেগমের সন্তান প্রসবের তারিখ ছিল গত (৩ অক্টোবর)। কিন্তু প্রসব বেদনার জন্য একমাস আগেই গত (২ সেপ্টেম্বর) পৌরশহরের বেসরকারি ক্লিনিকে সিজার করে সন্তানের মা হন তিনি। মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন আগেই করা ছিল। গত (৪ সেপ্টেম্বর) ছুটি নিশ্চিত্বের জন্য এক আত্মীয়কে ডাক্তারের সনদসহ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে পাঠান। কিন্তু শিক্ষা অফিসার মর্জিনা পারভীন প্রসূতি ও নবজাতককে সরাসরি অফিসে আসতে বলেন। নিজের চোখে না দেখে ছুটি মঞ্জুরের নিয়ম নেই বলে সাফ জানান। গত (২০ সেপ্টেম্বর) মাকছুদা বেগম ১৮ দিনের অসুস্থ বাচ্চা এবং অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে সাথে নিয়ে উপজেলা পরিষদ ভবনের তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে শিক্ষা অফিসে যান। অসুস্থ মাকছুদাকে সিঁড়িতে হাফাতে দেখে এগিয়ে আসেন দুই মহিলা কর্মচারি। মাকছুদা বেগম জানান, সিজারের পর পেটের সেলাই নিয়ে যন্ত্রনায় ছিলাম। বাচ্চাটার ঠান্ডা ছাড় ছিল না। কিন্তু ম্যাডামের কড়া নির্দেশ। তাই কাহিল শরীরে অতিকষ্টে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে ছুটি নিশ্চিত করি।
মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে একইভাবে হয়রানি হয়েছেন ভেঙ্গুগুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা কানিজ ফাতেমা। দ্বিতীয় বার মা হতে গেলে ডাক্তার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ দেন গত (১৫ নভেম্বর)। এর মধ্যেই তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য আবেদন করে রাখেন। কিন্তু ডাক্তারের দেয়া তারিখের ১৭ দিন আগেই গত (২২ অক্টোবর) ময়মনসিংহের একটি ক্লিনিকে সিজার করে সন্তান লাভ করেন। দু’দিন পর স্বামী গোলাম মাওলা উপজেলা শিক্ষা অফিসে ডাক্তারের সনদসহ ছুটির আবেদন নিয়ে গেলে শিক্ষা অফিসার ছুটি মঞ্জুর করতে অস্বীকার করেন। বরং ছুটি না নিয়েই কেন সন্তান প্রসব ও স্কুল কামাই করলেন অভিযোগে কানিজ ফাতেমাকে শোকজ করেন। একইভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে হয়রানি হন ভোলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক উম্মে হাবীবা। ডাক্তার সন্তান প্রসবের যে সম্ভাব্য তারিখ দেন অসুস্থতার কারণে তার ৩৫ দিন আগে সীজারে সন্তান প্রসব করানো হয়। উম্মে হাবীবার স্বামী সোহানুর রহমান শুভ ডাক্তারের সনদপত্রসহ ছুটির আবেদন নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গেলে তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। প্রসূতি ও নবজাতককে প্রয়োজনে এ্যাম্বুলেন্সে করে অফিসে হাজির করার নির্দেশ দেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে হয়রানির শিকার হন সূতি হিজলীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সালমা খাতুন এবং জোত আতাউল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তাসলীমা খাতুন। সালমা খাতুন জানান, সন্তান সম্ভবা একজন মাকে ডাক্তাররা ভারী কাজ করা, সিড়ি বেয়ে উঠা এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে মানা করেন। আবার সিজারের পরও একই ধরনের পরামর্শ থাকে। কিন্তু ছুটির জন্য একজন প্রসূতিকে তিনতলার সিঁড়ি ভেঙ্গে অফিসে যাওয়া বাধ্যতামূলক করায় খুবই সমস্যা হয়।উপজেলা শিক্ষক কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আব্দুল করিম জানান, গত আগস্টে শিক্ষা অফিসার মর্জিনা বেগম যোগদনের পর মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে প্রসূতিদের হয়রানি চলছে। অফিসের বারান্দায় বেআইনী নোটিস টানিয়ে বলা হয়েছে। কোন শিক্ষক দুপুর তিনটার আগে অফিসে প্রবেশ করতে পারবেন না। এতে শিক্ষকরা জরুরী কাজে যেমন অফিসে প্রবেশ করতে পারেন না। তেমনি দূরদুরান্ত হতে আগত প্রসূতিদের মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষা করতে হয়।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার আনোয়ার হোসেন জমাদ্দার জানান, মাতৃত্বকালীন ৬ মাসের ছুটি কর্মজীবি নারীর অধিকার। জরুরী ক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের পরেও ছুটি নিতে কোন বাধা নেই। গোপালপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার জানান, একজন নারী কর্মকর্তা আরেকজন কর্মজীবি নারীর প্রসূতিকালীন ছুটি নিয়ে কিভাবে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারেন ভাবতে অবাক লাগে। যিনি নিজেই মানবিক আচরণ করতে জানেন না। তিনি কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মানবিক করে তুলবেন?এ ব্যাপারে গোপালপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মর্জিনা পারভীন অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করে জানান, তিনি সরকারি নিয়মানুযায়ী অফিস চালান। কাউকে কখনো হয়রানি করেননি। নিয়ম অনুযায়ীই বারান্দায় নোটিশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পারভেজ মল্লিক হয়রানির সত্যতা স্বীকার করে জানান, নোটিস টানিয়ে শিক্ষকদের অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারো কোন এখতিয়ার নেই। সবার সাথে দুর্ব্যবহার ও অসৌজন্যমূলক আচরনের শত অভিযোগ রয়েছে ওই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে; খুব শিগগিরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসব জানানো হবে।