নুরুন নবী (জন্ম ১৯৪৯) একজন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও লেখক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একজন রাজনীতিবীদ এবং নিউ জার্সির প্লেইন্সবোরো শহরের কাউন্সিলর। তিনি কোলগেটের পণ্য ‘কোলগেট টোটাল’-এর সহ-উদ্ভাবক এবং বুলেটস অব ৭১ – অ্য ফ্রিডম ফাইটার’স স্টোরি বইয়ের লেখক।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে নিপুণ সমরকৌশলের জন্য তাকে কাদেরিয়া বাহিনীর ‘দ্য ব্রেইন’ বলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি তাকে ২০১৭ সালে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।ভাষা ও সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।নুরুন নবী ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার খামারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি স্থানীয় হেমনগর শশীমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়নে স্নাতক ডিগ্রি লাভরে পর শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরে জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ও ১৯৮০ সালে জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন।এরপর তিনি নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে আণবিক জীববিজ্ঞানে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন।
নুরুন নবী ১৯৭০-এর দশকে কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের সদস্য ছিলেন।পরবর্তীতে কোলগেট কোম্পানিতে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। কোলগেটের পণ্য ‘কোলগেট টোটালের’ সহ-উদ্ভাবক তিনি।তার নিজ নামে ১০০টির বেশি পেটেন্ট রয়েছে। ২২ বছর কোলগেটে কর্মরত থাকার পর ২০০৬ সালে কোলগেটের সহকারী পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।তার ৫০ এর অধিক প্রকাশনা রয়েছে। এছাড়াও তিনি আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন।১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহস্থালি ও স্বাস্থ্যসামগ্রী নির্মাতা কোলগেট-পামঅলিভ কোম্পানির গবেষণাগারে যোগ দিয়ে মলিকুলার বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তারপর তাকে ওরাল কেয়ার রিসার্চের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর অব টেকনোলজি করা হয়। দাঁত পরিচর্যা নিয়ে গবেষণা করে অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে তিনি ‘কোলগেট টোটাল’ উদ্ভাবন করেন।
এছাড়াও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের খবর নিয়ে ‘প্রবাসী’ নামে একটি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করেন যার সম্পাদক তিনি নিজেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নুরুন নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।[১২] ২৬ মার্চ প্রতিবাদী ছাত্রদের মিছিলে পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষন করলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং কিছুদিন পর অহত অবস্থাতেই টাঙ্গাইল চলে যান। সুস্থ হওয়ার পরপরই ছাত্র, কৃষক, মজুরসহ সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে যোগ দেন টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীতে।
নুরুন নবী যুদ্ধ পরিকল্পনা ও বার্তাবাহকের কাজে অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি সম্মুখ যুদ্ধ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় কমান্ডারদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের মত গুরত্বপূর্ন কাজ করেছেন। তিনি ভারতীয় সীমান্ত পাড় হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের জোগান দিতেন এবং ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর যখন ভারতীয় ছত্রীসেনা টাঙ্গাইলে অবতরণ করে তখন নুরুন নবী অর্কেস্ট্রাবাদক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি ‘কমিটি ফর দ্য রিয়ালাইজেশন অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার আইডলস অ্যান্ড ট্রায়াল ফর বাংলাদেশ ওয়ার ক্রিমিনালস’-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭২ সালের ৬ মে ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ সাময়িকী মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী ভূমিকার জন্য জন্য তাকে টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর ‘দ্য ব্রেইন’ বলে উল্লেখ করে।
১৯৬৬-৬৭ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছাত্র আন্দোলনের ১১ দফা দাবি ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সক্রিয় কর্মী নুরুন নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।[৬] আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে সত্তরের নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ২০০৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যোগ দেন। একই বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি রাজ্যের প্লেইন্সবোরো টাউনশিপ কমিটির কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন। চতুর্থ মেয়াদে তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন। রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রাট দলের অনুসারী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮০ সালে গঠিত ‘কমিটি ফর ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশ’ গঠনেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
নুরুন নবী বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
আমার একাত্তর আমার যুদ্ধ (২০০৪)
জন্মেছি এ বাংলায় (২০০৬)
আমেরিকায় জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি (২০১৫)
জন্ম ঝড়ের বাংলাদেশ (২০১৭)
চার তারার আলো (২০১৯)