উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বাস্তবায়নে হাইকোর্টের নির্দেশ!

উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কাগজপত্র ও নথি অনুমোদনের জন্য নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করতে হবে, এটিসহ এ-সংক্রান্ত বিধি ও প্রজ্ঞাপন নিশ্চিত করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এ সংক্রান্ত জারি করা রুলের সঙ্গে সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার ভার্চুয়াল বেঞ্চ এমন আদেশ দেন।আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ও তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নওরোজ মো. রাসেল।

আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, উপজেলা পরিষদ আইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে উপজেলা পরিষদ জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। প্রশাসন এ কাজে সাচিবিক দায়িত্ব পালন করতে সহায়তা দেবে। উপজেলা পরিষদ আইন, উপজেলা পরিষদ (কার্যক্রম বাস্তবায়ন) বিধিমালার (১৪৯১) উপবিধি ও ২০১০ সালের ১৭ জুনের প্রজ্ঞাপনে তা–ই বলা আছে।কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ উপজেলা জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে ইউএনও পরিষদের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা আইন ও বিধিমালার পরিপন্থী, যে কারণে ওই উপবিধি ও প্রজ্ঞাপনের বাস্তবায়ন চেয়ে সম্পূরক আবেদন করা হলে হাইকোর্ট আজ (মঙ্গলবার) এই আদেশ দেন।

এ আইনজীবী জানান, উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তর/কর্ম উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর বিষয়ে ২০১০ সালের ১৭ জুন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে ইউএনও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে তার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। তিনি পরিষদের অর্থ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সব প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করবেন। উপজেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা দেবেন। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বর উপজেলা পরিষদের (কার্যক্রম বাস্তবায়ন) বিধিমালায় সংশোধনী আনা হয়।সংশোধিত ১৪(১) উপবিধিতে দপ্তরগুলোর কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত বিষয়ে সব কাগজপত্র ও নথি, ইউএনওর মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করবেন। তবে ওই প্রজ্ঞাপন ও সংশোধিত উপবিধির বাস্তবায়ন হচ্ছে না উল্লেখ করে রিট আবেদনকারীরা সম্পূরক আবেদন করেন, যার ওপর মঙ্গলবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও) কীভাবে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন তা জানতে চেয়ে এর আগে গত ৬ জানুয়ারি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।

এছাড়া অপর এক রুলে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও আর্থিক শৃঙ্খলা আনয়নসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের (ইউএনও) সাচিবিক দায়িত্বপালনের বিধান সম্বলিত উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩ ধারা কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল।

সেইসঙ্গে উপজেলার বিভিন্ন কমিটিতে ইউএনওকে সভাপতি এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করা সংক্রান্ত পরিপত্র কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। রুল জারির ১০ দিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, আইন সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছি!

তখন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম সাংবাদিকদের বলেন, মাঠ প্রশাসন কোনো চিঠিপত্র লিখলে বা অনুষ্ঠান করলে দাওয়াতপত্র বা ব্যানারে উপজেলা পরিষদ না লিখে উপজেলা প্রশাসন লিখছে। এর মাধ্যমে ইউএনওরা স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এছাড়া, সরকারি কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে যতগুলো কমিটি গঠন করা হয় তার সবগুলোতে ইউএনওকে চেয়ারম্যান করা হয় এবং উপজেলা চেয়ারম্যানদের করা হয় উপদেষ্টা।

আবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ থাকে ইউএনও ইচ্ছে করলেই আরও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। তেমনি অনেক ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের হিসাবও তাদেরকে দেওয়া হয় না। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও স্থানীয় সরকার পদ্ধতির চেতনার পরিপন্থী।

এই আইনজীবী বলেন, উপজেলা পরিষদ আইনের ৩৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এবং তিনি পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন।’ ৩৩ এর (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য কার্যাবলী পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করবেন।’ কিন্তু তা সঠিক ভাবে হচ্ছে না।

তাই গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এই ৩৩ ধারাসহ একটি পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সংগঠনের সভাপতি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মনোহরদী উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু, উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রিনা পারভীন, ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম আহম্মেদ ও ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার।

রিটের শুনানিতে হাসান এম এস আজিম বলেন, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা ইউএনও বাস্তবায়ন না করলে পরিষদের করণীয় কিছু থাকে না। উপজেলা পরিষদের কাছে ইউএনওর জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা আইনে রাখা হয়নি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকে এই একটি ধারার মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই ৩৩ ধারা সংবিধানের ৭ ও ৫৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। ৫৯(১)-এ স্থানীয় শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে।

তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (সংশোধিত ২০১১) অনুযায়ী উপজেলায় থাকা ১৭টি দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের কাজ উপজেলায় হস্তান্তরিত। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই ১৭টি বিভাগের যেসব কমিটি করা হয়েছে এর সবগুলোতেই সভাপতি নির্বাহী কর্মকর্তা। আর উপদেষ্টা করা হয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানকে। একইভাবে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হচ্ছেন ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা। অথচ একই প্রজ্ঞাপনে ইউনিয়ন ও পৌরসভায় আয়ন-ব্যয়ন কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র।

আইনজীবী এম এস আজিম আমার টাঙ্গাইল কে আরও বলেন, অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, দেশের ৪৯২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের কোনো দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, উল্টো সব ক্ষমতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন।

পরে রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেছিলেন।

Share this post

PinIt
submit to reddit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top