গারো পরিবারের জেসি এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক!

৩৩তম বিসিএসে প্রশাসনে চাকরির সুযোগের খবর যখন এলো, তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক হিসেবে চার মাস পার করেছেন। স্বজনদের সবাই যোগদান করার অনুরোধ করলেন। তাদের সবাইকে এক রকম হতাশই করলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপদে বহাল থাকলেন। প্রশাসনের ওপরে ওঠার অপার সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিলেন। এক রকম উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মহান শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিলেন তিনি।বলছি— টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বনাঞ্চল ভুটিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী গারো পরিবারের সদস্য জেসি ডেইজি মারাকের কথা। তিনি ওই গ্রামের মধুনাথ সাংমার মেয়ে। তিনি আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র গারো শিক্ষক। দেশের অন্যতম সেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে প্রভাষক হিসেবে তিনি কর্মরত।পরিবারসহ শিক্ষিত স্বজনদের মধ্যে ৮০ শতাংশ সদস্য পেশায় শিক্ষক। এমন পরিবারে জন্ম নেওয়া ডেইজির চিকিৎসক হওয়ার দুই চোখজুড়ে স্বপ্ন ছিল। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার ফলে মেধাতালিকায় নিজের নাম না পেয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায় দেখে হোঁচট খান। তবু তিনি এতে থেমে থাকেননি। ভর্তি পরীক্ষা দেন ঢাবির ‘ঘ’ ইউনিটে। সুযোগ হয় ভাষা বিজ্ঞান শাখায়।

২০০৫-০৬ সেশনে ভর্তি হন। স্বপ্নভঙ্গ মনে নানা শঙ্কায় ভাষা শিক্ষা বিভাগের প্রথম ক্লাসে গিয়েই পাল্টে যায় সব। প্রফেসর জিনাত ইমতিয়াজ আলীর ‘ফোনেটিক্স অ্যান্ড ফোনোলজি ’ বিষয়ের লেকচার এ পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে যায়। একে একে প্রফেসর সালমা নাসরিনের গোছানো শ্রেণি কার্যক্রম, প্রফেসর শাহরিয়ার রহমানের ভাষাবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ ক্লাসে নিজেকে বেঁধে ফেলেন তিনি। তাদের ক্লাস হয়ে ওঠে আকর্ষণী শক্তি।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে স্প্যানিশ ও জার্মান ভাষা শিখেন। ২০১৫ সালে অনিত্য মানখিনের সঙ্গে সংসার শুরু করে এখন শিক্ষকতার পাশাপাশি দুই মেয়ে নিয়ে সংসার সামলান।

একান্ত আলাপচারিতায় কিছুক্ষণের জন্য তিনি চলে গিয়েছিলেন জীবনের পেছনের দিকে। তিনি জানান, বিগত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে মধুপুরের লালমাটির গ্রাম ভুটিয়ার মধুনাথ সাংমার মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। মা মিনু হাজং শিক্ষক ছিলেন। মায়ের বাবা শিক্ষক, মামা-খালারা শিক্ষক। বাবা উন্নয়ন সংগঠনে চাকরি করলেও শুরুটা ছিল শিক্ষকতা দিয়ে। ছোট সহোদর বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।তৃতীয় শ্রেণি পার হতেই পরিবার নির্বিঘ্নে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ দিতে নেত্রকোনার মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিরিশিরি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। হোস্টেলের সদস্য হন এতটুকু বয়সেই। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার সংগ্রামে সেই যে বাড়ি ছাড়া। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছেন। এসএসসি ও এচইএসসিতে জিপিএ পাওয়া জেসি ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন।

বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আবার অনেক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে পারেননি। তাই জীবন নিয়ে তার অনুধাবন হলো যে কোনো মুহূর্তেই অনেক সম্ভাবনার পথ থাকে। কঠিন কোনো পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়তে নেই । এটি হলো উত্তরণের পথে প্রত্যেক মানুষের কাছে তার দাবি।

মধুপুরের গারো নারী সংগঠন আচিক-মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গারো চাকরিজীবীর অস্তিত্ব উল্লেখ করার মতো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে গারোদের পক্ষ থেকে ডেইজির আগে নারী তো দূরের কথা পুরুষের অস্তিত্বও খুঁজে পাইনি। ডেইজি আমাদের গারো ও নারী সমাজের অহংকার।

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক জানান, গারোদের মধ্য থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ ডেইজিই প্রথম পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র। তার জন্য আমরা গর্বিত। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে গারো এ শিক্ষককে নিয়ে আলোচনা করতে পেরে এ গর্বের কথা বলে জানান তিনি।

বাবা মধুনাথ সাংমা জানান, গারো সম্প্রদায়ের প্রশাসনে কেউ নেই। ওকে প্রশাসনে যোগ দিতে বলেছিলাম— প্রশাসনে গারোদের প্রতিনিধিত্ব তৈরি করার জন্য। আমাদের গর্ব হওয়ার সঙ্গে সহায়ক একটা পরিবেশ আমাদের হতো। তার পরও গারো প্রতিনিধি হিসেবে চবির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া কম গর্বের নয়। তিনি মনে করেন— পরিবারেরই শুধু নয়, দেশের গারো সম্প্রদায়ের গর্ব ডেইজি।

চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শ্রাবণী মল্লিক বলেন, একাডেমিক হাইপ্রোফাইলের ডেইজিকে পেয়ে চবির এই ইনস্টিটিউট সমৃদ্ধ। শিক্ষার প্রতি তিনি খুবই ডেডিকেটেড। বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতি সত্তা তথা নিজের মান্দি ভাষার বিশেষ সৌন্দর্যের ব্যাখ্যার তত্ত্ব খুঁজে বেড়ান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ভাষা, কালচার, ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টায় তার আগ্রহ ও চিন্তা খুবই উঁচু মানের। ইতোমধ্যে মারমাদের ভাষা রক্ষার গবেষণাকাজ তার চিন্তা-চেতনার বহির্প্রকাশ। তিনি তার এমন চিন্তা-চেতনার বিকাশে সহযোগিতায় কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

Share this post

PinIt
submit to reddit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top