অবশেষে গ্রেপ্তার হলেন আলোচিত-সমালোচিত- বিতর্কিত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীর!

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত সমালোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীর এর বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। শত শত অভিযোগের ভিত্তিতেই আজ রাত‌ হঠাৎ করেই তার বাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। উক্ত অভিযানে থেকে সর্ব শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গেছে। সে হিসেবে আটক করা হয়েছে সমালোচিত বহিস্কৃত আওয়ামী লীগ নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে।

অনলাইন টিভি জয়যাত্রায় নিয়োগ দিয়ে বেতন না দেওয়া, জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বার্ষিক চাঁদা নেওয়া, সংবাদ প্রকাশের জন্য টাকা নেওয়া, উগ্র আচরণ, জমি দখলসহ নানা অভিযোগে আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীর। বিভিন্ন মহলে তাঁর পরিচয়ও ভিন্ন ভিন্ন, কখনো তিনি শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, লেখক, অনুমোদনহীন আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে বহিষ্কার হওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের পরিচিতি একজন রহস্যময় নারী হিসেবে।

২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তিনি আওয়ামী ঘরানার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন। নিজেকে নিরাপদে রাখতে সাংবাদিক পরিচয় ধারণ করেন। একটি অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড সংগ্রহ করে নিজের ফেসবুকে কার্ডের ছবি পোস্ট করে সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি কিভাবে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড পেলেন, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন মূলধারার একাধিক সাংবাদিক। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলও এ নিয়ে সে সময়ে ফেসবুকে মন্তব্য করেন।

হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা নামে একটি আইপি টিভি ও জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের অন্যতম পরিচালক ছিলেন জি এম শাহজাহান, তিনি নিজেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচয় দিতেন। ২০১৬ সালে হেলেনা জাহাঙ্গীর তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দেওয়া জি এম শাহজাহানকে দিয়ে মিরপুর কালশী সড়কে রাজউকের জায়গা দখল করে রাতারাতি বিপণিবিতান নির্মাণ করে ভাড়া দেন। জমি দখল করায় রাজউক জি এম শাহজাহানের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং বিপণিবিতানটি ভেঙে দেয়। ওই সময়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন দাদন ফকির। তিনি রাজউকের জায়গা বুঝে পেতে সহায়তা করায় হেলেনা জাহাঙ্গীর জি এম শাহজাহানকে দিয়ে দাদন ফকিরের নামে মামলা করে দীর্ঘদিন তাঁকে হয়রানি করেন। এরপর হেলেনা জাহাঙ্গীর জি এম শাহজাহানকে দিয়ে রূপনগর এলাকায় রাজউকের দুটি প্লট দখল করেন।

বিএনপি নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীরের হঠাৎ করে আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রতিবেদক জিয়াউর রহমানকে হত্যার হুমকি দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিয়াউর রহমান রাজধানীর পল্লবী ও শাহবাগ থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

কয়েক মাস আগে হেলেনা জাহাঙ্গীরের জয়যাত্রা টিভির ভোলা প্রতিনিধি তুহিনের সঙ্গে প্রধান কার্যালয়ের একজন নারী কর্মকর্তার কথোপকথন ভাইরাল হয়। দেখা যায়, জয়যাত্রা টিভির প্রধান কার্যালয়ের নারী কর্মকর্তা বলছেন, ‘টাকা না পাঠালে কোনো সংবাদ প্রকাশ হবে না। টাকা না দিতে পারলে আপনাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নেওয়া হবে।’ অভিযোগ রয়েছে, এভাবে সারা দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৫ থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত টাকা নিয়ে।

জয়যাত্রা টিভির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলা হয়। ওই গ্রুপের আদান-প্রদান করা খুদে বার্তায় দেখা যায়, একাধিক বিকাশ নম্বর দিয়ে বার্তা পাঠানো হয়েছে, যেখানে বার্ষিক চাঁদা উপজেলা প্রতিনিধি দুই হাজার ও জেলা প্রতিনিধিকে তিন হাজার টাকা পাঠাতে হবে। এ ছাড়া প্রতিনিধিরা সংবাদ পাঠালে বার্তা দিয়ে বলা হয়, বিকেলের আগে টাকা না পাঠালে ৮টার সংবাদে নিউজ প্রচার হবে না। এখানে টাকার অঙ্ক উল্লেখ করা হয়নি, এটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কমার্শিয়াল ধার্য।’

অভিযোগ রয়েছে, হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টিভিতে কর্মী নিয়োগ দেন, তবে বেতন দেন না। নিয়োগের পর তিন থেকে চার মাস সময়কে পরীক্ষামূলক সময় বলা হয়, এরপর বেতন দাবি করলেই নানা দোষত্রুটি খুঁজে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়।

বর্তমানে একটি জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেলে কর্মরত একজন নারী সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমিও চার মাস কাজ করে খালি হাতে ফিরেছি। তবে সে লজ্জার কথা এখন বলতে চাই না।’

তাঁর অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের খোঁজ পাচ্ছে গোয়েন্দারা-হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তাঁর অনেক আর্থিক দুর্নীতির খোঁজ পেয়েছেন সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গতকাল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে হেলেনার নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বিভিন্ন সময় তাঁর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ রকম ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া দলের নাম ভাঙিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে জানিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামেও তিনি আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে তদন্তে জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের চলাফেরার ওপরও নজরদারি অব্যাহত আছে। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নানা সময়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্য ধরেও তদন্ত চলছে। বিশেষ করে সরকারবিরোধী একাধিক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তাঁর যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে পাওয়া তথ্য আরো যাচাই-বাছাই চলছে।

Share this post

PinIt
submit to reddit

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top